রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩৪ পূর্বাহ্ন
#শুক্রবারের_গল্প
আজকের গল্প: কী হয়েছিল পহেলা জুন?
লেখক: #মনদীপ_ঘরাই
ঘুম থেকে উঠে রাহাত সাহেব শুনলেন, ড্রয়িংরুমে তার অপেক্ষায় একজন রিপোর্টার বসে আছেন। ইদানিং সাংবাদিকদের বেশ আনাগোনা হচ্ছে বাসায়। এ নিয়ে রাহাত সাহেবের বেশ একটা ভালো লাগাই কাজ করে। তিনি আস্তে আস্তে বিখ্যাত হচ্ছেন। সবার মুখে ছড়িয়ে পড়ছে তার নাম। মধ্য চল্লিশে এসে তার মতো একজন অতি সাধারণ মানুষ হুট করে বিখ্যাত হয়ে গেল, ভাবতেই তো অন্যরকম লাগে।
বিখ্যাত হবার ঘটনাটার শুরু অফিসে ।তার ডিপার্টমেন্টের হিসেবের খাতার একটা পাতা দুবার দেখেই বসের কাছে হুবহু বর্ণনা করেছিলেন রাহাত সাহেব। এই স্মৃতিশক্তি দেখে বস অবাক হয়ে বলেছিলেন, “আপনি তো জিনিয়াস!”সেদিন সবাইকে ব্যাপারটা আড়ম্বর করে জানাতেও ছাড়েন নি তার বস আজমল সাহেব।
এমনিতেই পুরোনো স্মৃতি মনে রাখার ব্যাপারে বন্ধু মহল ও পরিবারে তার বিশেষ সুনাম ছিল। এবার তার সাথে যোগ হলো সংখ্যার ম্যাজিক। সেদিন বসের ওই প্রশংসার পর বাসায় এসে শুরু করলেন সংখ্যা মনে রাখার খেলা। মাসখানেকের চর্চায় এক আজব ব্যাপার ঘটলো। একবার দেখে পাতার পর পাতা সংখ্যা মুখস্ত বলতে শুরু করলেন রাহাত সাহেব।
শুরুর পরীক্ষাটা দিলেন স্ত্রী নীরার কাছে। সে অবাক হয়ে শুধু বললো, ” তুমি আসলেই জিনিয়াস!”
এরপর ফেসবুকে লাইভে একদিন দেখালেন সংখ্যা মনে রাখার খেলাটা। ভাইরাল হতে ১০-১২ ঘন্টার বেশি সময় লাগে নি।
এরপর অনলাইন পত্রিকায় খবর বেরোলো, টিভি চ্যানেলগুলো ইন্টারভিউ নিল। তাঁর নতুন নাম হয়ে গেল “জিনিয়াস রাহাত”। সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি,পত্রিকায় খবরের পর খবর হতে লাগলো।
একসময় সব খবরের মোমবাতি জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায়। তারপর মানুষ ভুলতে শুরু করে বিখ্যাত মানুষকেও। এই পর্যায়ে বিখ্যাত মানুষরা তৈরি করেন সাফল্যের নতুন সাইড স্টোরি।
তার সংখ্যার খ্যাতিও প্রায় হারিয়ে যায় যায় অবস্থা।এমন সময় রাহাত সাহেব স্মৃতির পাতা হাতড়ে তুলে এনেছেন ২০ বছর আগের তার এক বীরত্বের সাইড স্টোরি। এই গল্পই তাকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে মিডিয়ায়। সবাই এখন আলোচনায় মুখর “পহেলা জুনের গল্প” নিয়ে।
আজকের রিপোর্টারও নিশ্চয়ই সে গল্প নিয়েই নিউজ করবে।
“থাকুক একটু বসে। এখন তো সময় আমার।”, আপন মনেই এ কথা বলে দাঁত ব্রাশ করতে চলে গেলেন রাহাত সাহেব। প্রাতঃরাশের টেবিলে পত্রিকাটা হাতে নিয়ে দেখলেন আজ তারিখটাও ১ লা জুন। বাহ্। বেশ ভালো তো। আজকের নিউজটা একটা বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
যাবতীয় সব কাজ সেরে আধা ঘন্টা পরে ড্রয়িং রুমে ঢুকেই দেখলেন মাঝবয়েসী একজন লোক বসে আছে। এই মানুষটিকে আগে দেখেছেন বলে মনে পড়ছে না। নতুন কোন পত্রিকার হবে হয়তো।
রাহাত সাহেবকে রুমে ঢুকতে দেখে হাতের প্যাড আর কলমটা টি টেবিলে রেখে লোকটা দাঁড়িয়ে গেল। রাহাত সাহেব কোনরকম ভূমিকা ছাড়াই বললেন,
” পহেলা জুনের ঘটনাটা শুনবেন তো?”
সাংবাদিক লোকটি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, রাহাত সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে গল্প শুরু করলেন।
” বছর বিশেক আগের কথা। সেদিনও আজকের মতো পহেলা জুন ছিল।তখন আমি বয়সে তরুন। বেশ ডানপিটেও ছিলাম। দাদা বাড়িতে গিয়েছিলাম ছুটিতে। রাতের খাওয়া শেষে সবাই শুতে গেল।আমি উঠানে বসে চাঁদ দেখছিলাম আর রেডিওতে ক্রিকেট ম্যাচ শুনছিলাম। হঠাৎ বাড়িতে ডাকাত পড়লো। বাড়িতে দাদা, দাদি আমি আর এক চাচাতো ভাই ছাড়া কেউ ছিলো না।ডাকাতরা সাত আটজন এসে দাদা দাদীর ঘরে ঢুকে তাদেরকে বেঁধে ফেললো। চাচাতো ভাই ভয়ে পেছনের জানালা ভেঙ্গে পালিয়ে গেল। আর আমি উঠানের চৌকির নিচে রাখা দা টা নিয়ে অতর্কিতে ডাকাতদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। পর পর তিনটাকে কোপ দিয়েছিলাম মনে আছে স্পষ্ট। আমার স্মৃতিতো আপনি জানেনই। ঘটনার আকস্মিকতায় ডাকাতেরা পালিয়ে যায়। তবে যাবার আগে ওরা আমার হাতে একটা কোপ দিয়েছিল রামদা দিয়ে।এই দেখেন দাগ। আর…আমার দাদার পিঠ আর ঘাড়ে কোপ দিয়েছিল কয়েকটা। দাদাকে আর বাঁচাতে পারি নি সেদিন। তবে, ঘর থেকে একটা জিনিষও নিয়ে যেতে দিই নি ডাকাতের দলকে। পরদিন সেই তিনজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। বাকিরাও ধরা পড়েছে কয়েকদিন পর। এই তো পহেলা জুনের কাহিনী। বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে তো, তাই একটানে বলে ফেললাম। আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে আপনি করতে পারেন।”
এতক্ষণের নীরবতা ভেঙ্গে লোকটি বললো,
” আপনার তো সুপার মেমোরি। বলুন তো সেদিন আপনি কী রঙের জামা পড়া ছিলেন?”
খানিকটা অবাক হয়ে রাহাত সাহেব বললেন, ” আপনি তো দেখি অন্যরকম রিপোর্টার হে! নিউজটা আশাকরি মারাত্মক হবে।এ প্রশ্ন আপনিই প্রথম করলেন। চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি নীল রঙের শার্ট পরা ছিলাম।”
লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলো, ” আর বোতাম কী রঙের ছিলো?”
রাহাত সাহেব এবার বিরক্ত হলেন খানিকটা, ” আরে ভাই, আপনি কী জামা নিয়ে স্টোরি করবেন নাকি? কী অদ্ভুত প্রশ্ন!বোতাম ছিল কালো রঙের। আর কোন প্রশ্ন করার দরকার নেই।”
লোকটা এবার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে বললো,” আর কোন প্রশ্ন করবো না। তবে, স্মৃতিশক্তির জন্য বিখ্যাত মানুষটা সেই পহেলা জুন সম্পর্কে এতকিছু ভুলে বসে আছে জেনে অবাক হলাম।”
রাহাত সাহেবের রাগ বাড়ছে, ” এই মিয়া, আপনি কী বলতে চান বলেন তো? আমি কখনো কিছু ভুলি না।”
রিপোর্টার লোকটি রাহাত সাহেবকে মুখের সামনে আঙ্গুল নিয়ে ইশারা করে চুপ করতে বললেন। এবার তার বলার পালা,
” সেদিনের সেই রাতে আপনার দাদার বাড়িতে আপনারা চারজন ছাড়া আরও একজন ছিল। কুসুম। আপনার দুঃস্ম্পর্কের চাচাতো বোন।”
রাহাত সাহেবের কপালে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম জমছে।
” আর আপনার চাচাতো ভাই সেদিন পালিয়ে যান নি। আপনার দাদা আর চাচাতো ভাই মিলে তিনজন ডাকাতকে আহত করেছিলেন। সেই আক্রমনের সময় পাল্টা আঘাতে আপনার দাদা মারা যান, আপনার চাচাতো ভাই সব্দুলের কপালে সাতটা সেলাই লেগেছিলো”
” আপনি কী সব্দুল? মানে তুই কি সব্দুল? ”
” আমি সব্দুল না। আপনি জবাব দিন, সে সময় আপনি কোথায় ছিলেন? ”
” আমি….আমি…”
” আমি বলছি আপনি কোথায় ছিলেন।আপনি লুকিয়েছিলেন কুসুমের ঘরে। ”
” মিথ্যা কথা। একদম মিথ্যা কথা। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র”
” আপনি সে রাতে ওর ঘরের আলো নিভিয়ে ঘুমন্ত কুসুমের চোখ বেঁধে ফেলেছিলেন। জোর করে ধর্ষণ করেছিলেন নিষ্পাপ মেয়েটিকে। ও শেষ মুহূর্তে বালিশের নিচে রাখা দা দিয়ে আপনার হাতে কোপ দিয়েছিল। আপনার হাতের ক্ষতটা কুসুমের করা আঘাতের”
” আপনি কে? কে আপনি?”
” আমি কুসুমের স্বামী।আজ এত বছর ঘর করেও আমার স্ত্রীর মন থেকে ওই ভয়াল স্মৃতি আর গ্লানি মুছতে পারি নি। সেদিন আপনারা ধর্ষনের দোষ চাপিয়েছিলেন ডাকাতদের ওপর”
হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রাহাত সাহেব, ” এসব নোংরা মিথ্যা বলছেন কোন সাহসে? আপনাকে পুলিশে দেব আমি। কী প্রমান আছে আপনার কাছে?”
” আমার কোন প্রমান দেবার প্রয়োজন নেই। আমি আপনাকে শাস্তি দিতে চাই না। শুধু কুসুমের ধর্ষিতা হবার যে গ্লানি আছে, তা কমিয়ে দিতে এসেছি। আপনাকে ধর্ষকের গ্লানিতে পোড়াতে এসেছি। ওই দেখুন পর্দার ওপারে দাঁড়িয়ে আপনার স্ত্রী এতক্ষণ সবকিছু শুনে ডুকরে কাঁদছেন। এবার নিজের পরিবারের কাছে ধর্ষক পরিচয়ে বাকি জীবনটা বেঁচে দেখুন কুসুমের কষ্টটা কতখানি। আমি চললাম”
এ কথা বলে লোকটা চলে যাবার সময় রাহাত সাহেবের হাতে কিছু একটা দিয়ে গেলো।
রাহাত সাহেবের স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে গেছে পুরোপুরি। সংখ্যাগুলোও সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে একের পর এক।
তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাতটা খুলে দেখলেন, লোকটা একটা বোতাম দিয়ে গেছে। কালো বোতাম।